রহস্যময় বিষয়ঃ ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত/রহস্যজনক ফুটবল বিশ্বকাপ ১৯৭৮
ফুটবল বিশ্বকাপকে বলা হয় ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি লোক একই সময়ে টিভি পর্দায় চোখ রাখে এই বিশ্বকাপের ফাইনালেই। যে যুদ্ধটা মধ্যযুগে অস্ত্রে হত, তুলনামূলক সভ্য সমাজে সেই যুদ্ধটা হয় মাঠে, বল পায়ে, স্কিল দিয়ে। জাতিগত আবেগ আর অসাধারণ সব নৈপুণ্যে ভরপুর এই আয়োজনটি বিশ্বে অদ্বিতীয়। তবে সব সময়ই কি এই টুর্নামেন্ট বিতর্কের বাইরে থেকে কেবলই এক ক্রীড়াযুদ্ধ ছিল? না, ১৯৭৮ বিশ্বকাপটি ছিল এদিক থেকে ব্যতিক্রম। ছোটখাট বিতর্ক সব বিশ্বকাপ ঘিরে হলেও এই বিশ্বকাপের মতো বিতর্ক খুব কমই হয়েছে আজবধি।
সাধারণত কোন দেশে বিশ্বকাপ হয় তা কমপক্ষে ৫ বছর আগেই ঠিক হয়ে যায়। ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপের স্বাগতিক দেশের দায়িত্ব পায় আর্জেন্টিনা ১৯৭৬ সালের আগেই। কেন ১৯৭৬ সালটি বিশেষ করে বলা হলো? কারণ ১৯৭৬ সালে আর্জেন্টিনায় সামরিক অভ্যুত্থান হয়, ক্ষমতায় আসে ভিদেলের জান্তা সরকার। দেশে শুরু হয় অরাজকতা। চিরাচরিতভাবেই জান্তা সরকার দেশে চালায় হত্যা, গুম সহ নানা অত্যাচার। ভিন্নমতাবলম্বীদের ব্যাপকহারে গুম করে দেয়া হয়।
এদিকে জান্তা সরকার ক্ষমতায় আসায় হল্যান্ডের নেতৃত্বে বিভিন্ন দেশ শোরগোল তুলে বিশ্বকাপ স্থানান্তরের ব্যাপারে। কিন্তু একটি বিশ্বকাপ সরিয়ে নেয়া এত সহজ ব্যাপার না, তাই বিশ্বকাপ আয়োজন আর্জেন্টিনাতেই থেকে যায়। সব দল আসলেও বিশ্বকাপ বয়কট করেন ডাচ কিংবদন্তী, সেই আমলের সেরা ফুটবলার ইয়োহান ক্রুয়েফ ও জার্মান তারকা ডিফেন্ডার পল ব্রিটনার। মুখে অন্য পারিবারিক কারণ দেখালেও, ক্রুয়েফের অনেক কাছের লোকের ভাষ্যমতে এই সিদ্ধান্ত ছিল জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ। অবাক হবেন না, ক্রুয়েফ কেবল একজন ফুটবলারই নন, এর চেয়ে অনেক বেশী কিছু। কাতালান স্বাধীনতা থেকে শুরু করে যাবতীয় সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তার সদা উচ্চ সমর্থন থাকতো। বিশ্বকাপ তার প্রথম ধাক্কাটি খায় প্রথিতযশা দুই ফুটবলারের বর্জনের ভেতর দিয়ে।
টুর্নামেন্ট শুরুর কিছুদিন আগে আয়োজক কমিটির প্রধানকে হত্যা করে জান্তা সরকার, কারণ খবর পাওয়া গিয়েছিল, তিনি নাকি অতিরিক্ত ব্যায়ের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিতে পারেন। এদিকে অভাব আর হত্যায় ক্ষুব্ধ মানুষের মন জয় করার উপায় পেলেন জান্তা ভিদেলো ফুটবলের মধ্যে। তার সরকারের নীতি ছিল, খেলার মাধ্যমে উগ্র স্বদেশবাদ ঢুকিয়ে দাও আর নিজেরাও তা সাজো। রাস্তায় রাস্তায় ফ্রিতে আর্জেন্টিনার পতাকা দেয়া হলো। মানুষ ফুটবলে ভুলে রইল দেশের আসল অবস্থা।
স্বাগতিক আর্জেন্টিনা খুব কষ্টে হাঙ্গেরির সাথে ২-১ গোলে প্রথম ম্যাচে জিতে যায়। সেদিন রাতে এক আর্জেন্টাইন প্লেয়ারের কাছে আসে এক আর্মি অফিসার। হাসতে হাসতে বলেন, গ্রুপ থেকেই বাদ গেলে তা তো কেউ ভালোভাবে নেবে না। কথাটায় হাসিটা ছিল নকল। তখন সেই প্লেয়ারের মাথায় ঘুরছিল কেবল তার এক বন্ধু ভিন্নমতাবলম্বী থাকায় কীভাবে তাকে সেনাবাহিনী হত্যা করেছিল সেই বিষয়টি। প্রবল চাপের মধ্যেই আর্জেন্টিনা গ্রুপ পার করে খুড়িয়ে খুড়িয়ে।
এরপর ব্রাজিল, পেরু ও পোল্যান্ডের সাথে সেকেন্ড রাউন্ডের খেলা পড়ে তাদের। প্রথম ম্যাচ ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা দুই দলই জিতে নেয়, এরপরে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ম্যাচটি ড্র হয়। শেষ ম্যাচে ব্রাজিল ৩-১ গোলে জয় পেলে আর্জেন্টিনার জন্য সমীকরণ দাঁড়ায় কমপক্ষে ৪ গোলের ব্যবধানে জিততে হবে সেমিতে যাওয়ার জন্য। সেই ম্যাচের আগে আর্জেন্টিনার মোট গোল ছিল ৬টি। অন্যদিকে ৫ ম্যাচে পেরু গোল হজম করেছিল ৫টি। দেশের মাটিতে আর্জেন্টিনা হেরে গেলে তা জান্তা সরকারের জন্য কোনোদিকেই সুখকর হতো না। সেই ম্যাচটিই হয়ে দাঁড়ালো সবচেয়ে বড় বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। আর্জেন্টিনা ম্যাচটি জিতে যায় ৬-০ গোলে!
এরপরই শুরু হয় বিতর্ক। ফ্রান্স-আর্জেন্টিনা ম্যাচটি ঘিরে সেই সময়ই একটি রব উঠেছিল যে, কোনো এক ফরাসি প্লেয়ার নাকি দেখেছেন এক উর্দি পরা লোক প্লেয়ারদের নীল রঙের ট্যাবলেট সেবন করাচ্ছেন! সেই ম্যাচ পরে রব উঠল আর্জেন্টাইন প্লেয়ারদের জোর করে শক্তিবর্ধক ড্রাগ দেয়ার কথা। সেই সময়ের পেরু এত দুর্বল বা আর্জেন্টিনা এত সবল ছিল না যে স্কোরলাইন ৬-০ হতে পারে। ফলে একের পর এক ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আসতে থাকে।
আর্জেন্টিনা সে সময় পেরুর গমের এক বিশাল অংশের যোগানদাতা ছিল। ব্রিটিশ মিডিয়া দাবি করে যে, সেই গম নিয়ে নাকি পেরু সরকারকে চাপ দেয় আর্জেন্টাইন জান্তা সরকার। লাতিন আরো কিছু সাময়িকীতে আসে আরেক গুজব। আর্জেন্টিনার জেলে বন্দী ১৩ জন পেরুভিয়ান নাগরিককে মুক্তি দেবার বদলে এই জয়টি দাবি করে জান্তা সরকার। গুজবের বেশ কিছু গ্রহণযোগ্যতা ছিল আরো কিছু কারণে। প্রায় সপ্তাহ দুয়েকের মতো সময় হয়ে গেছে বিশ্বকাপের, ততদিনে আরো ছোটছোট নানা অভিযোগ জমা হয়েছে। নেদারল্যান্ড-স্কটল্যান্ড ম্যাচে নির্লজ্জ রেফারিং, মিডিয়াকে দেয়া চাপ এসব তো ছিলই, আরেকটি বড় কারণ ছিল আর্জেন্টিনা সবসময়ই খেলত রাতে, শেষ ম্যাচ হিসেবে, বাকি সব ম্যাচের ফল জেনে! তাই নানা গুজব বিশ্বজুড়ে প্রচুর গ্রহণযোগ্যতা পায়। এমনকি বেশ কিছুদিন আগেও এক পেরুভিয়ান সিনেটর দাবি করেন, ওই ম্যাচটি নাকি আসলেই পাতানো ছিল!
Comments
Post a Comment